উপন্যাসঃ বহুগামী আমি-১০৫

 


বহুগামী আমি

সৈয়দ আসরার আহমদ

পর্ব-১০৫

   রোববার সকাল আটটায় কেষ্টপুরে সাখোয়াতদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেলাম৷ দরজার গেটে নেম প্লেটে কেবল শ্রাবন্তীর নাম লেখা আছে৷ কারণটা বুঝতে আমার সময় লাগে নি৷ কলিং বেল চাপতে সাখোয়াত দরজা খুলে দিল৷ শ্রাবন্তী পাশের রুম থেকে হাসিমুখে এসে বলল, চিনতে কোনও অসুবিধা হয় নি তো?
- ধুৎ কি যে বলো শ্রাবন্তী! জানো না দিলু তো স্বপ্না ভাবিদের বাড়িতে বেশ ক'বার এসেছে৷
- তাই?
- হ্যাঁ সেদিন তো বললাম স্বপ্নাভাবিকে বউ
  সাজিয়ে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম৷
- ও হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে৷ যাক বসুন চা করে আনছি৷
আমরা দুই বন্ধুতে সোফায় বসে গল্প করছিলাম৷ এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠায় শ্রাবন্তী কিচেন থেকে বলল, সাখু দেখ কে এসেছে৷
সাখু দরজা খুলতেই স্বপ্নাভাবির ছোটবোন বাচ্চু জানতে চাইল, দেলোয়ারদা এসেছেন কি ?
- হ্যাঁ ওই তো সোফায় বসে আছে৷ তুমি ভিতরে আসো৷
- ওঁকে দেখা করতে তো এলাম৷ আর মা পাঠাল তাঁকে আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে বলতে৷
- ঠিক আছে তুমি ভিতরে এসে নিজেই তাকে বলো গিয়ে৷
-চলুন, তাই যাই৷ বৌদি কই?
- কিচেনে আছে চা করছে৷ তুমি বসো আমাদের সাথে চা খাবে৷
- কি দেলোয়ারদা কেমন আছেন? অনেকদিন পরে এলেন৷ আমাদের ভুলে গেছেন তাই না৷
- আরে বাচ্চু কি যা তা বলছ তোমাদের কখনও ভোলা যায়? মাসিমা কেমন আছেন? পার্বতীদি,কৃষ্ণাদি,ঝর্ণারা সবাই কেমন আছে?
- ওরা সবাই ভাল আছে৷ পার্বতীদি শ্বশুরবাড়িতে, মেজদি এখানে তিন দিন হল এসেছে৷ ঝর্ণাদি তো আসে না তাই ওর কথা বলতে পারব না৷
- কৃষ্ণাদির ছেলে মেয়ে হয়েছে?
- হ্যাঁ ওর দুই ছেলে৷ ভীষণ দুষ্টামি করে ওরা৷
- তাই বুঝি! বাচ্চারা দুষ্টামি না করলে ভাল লাগে৷ ওদের দুষ্টামিটাই সৌন্দর্য৷
- তা ঠিক দেলোয়ারদা আপনাকে মা দেখা করতে বলেছেন৷
- বসো চা খেয়ে যাচ্ছি৷
- বসেই তো আছি!
- তাহলে দাঁড়াও৷ Stand up.
আমার রসিকতায় বাচ্চু কল কল করে হেসে উঠল৷
তার হাসি দেখে সাখুও না হেসে পারল না৷
শ্রাবন্তী চা বিস্কুট মিষ্টি এনে আমাদের সামনে দিল৷ চা পর্ব সেরে আমি সাখোয়াতকে বললাম, সাখু আমি মাসিমার সঙ্গে দেখা করে আসি৷
- ঠিক আছে ঘুরে আয় আমি সেই ফাঁকে বাজার থেকে ঘুরে আসি৷
আমি আর বাচ্চু নিচে নেমে গেলাম৷ মাসিমা ঠাকুর ঘরে বসে ছিলেন৷ বাচ্চু চিৎকার করতে করতে বলল, ও মা, মা গো, এই দেখ দেলোয়ারদা এসেছে৷
- এই বাচ্চু আমি ঠাকুর ঘরে আছি৷ তোরা বস আমি আসছি ৷
বাচ্চুর হাঁকডাক শুনে কৃষ্ণাদি এসে হাজির৷ কি দেলোয়ার কেমন আছো?
- গড়িয়ে গড়িয়ে দিন চলে যাচ্ছে আর কি৷
- আপনি কবে এসেছেন শিলিগুড়ি থেকে?
- গত সপ্তাহে এসেছি৷ এই বাচ্চু দেলোয়ারকে জলখাবার এনে দে৷
- কৃষ্ণাদি কিছুই লাগবে না এই মাত্র শ্রাবন্তীর ঘর থেকে খেয়ে এলাম৷
- তাতে কি হয়েছে এখানেও অল্প করে খাও৷
- না নাহ কিছুই খাবো না মাসিমাকে কতদিন দেখিনি তাই দেখতে এলাম৷
আমরা তিনজনে গল্প করছিলাম প্রায় মিনিট পনের পরে মাসিমা ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন৷
মাসিমা আমাকে দেখে বললেন, তুমি অনেক রোগা হয়ে গিয়েছ? অসুখ টসুক হয়েছিল নাকি? কি সুন্দর মুখশ্রী ম্লান দেখাচ্ছে কেন?
ভাবছিলাম মাতৃহৃদয় তো সঠিক পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা আছে৷ আমি বললাম, না মাসিমা অসুখ বিসুখ হয় নি ঝঞ্চাট ঝামেলায় নানা চিন্তায় আছি তাই হয়তো আপনার চোখে ধরা পড়েছে৷
- বিয়ে করেছ?
- হ্যাঁ করেছি৷
-ছেলে মেয়ে হয়েছে?
- হ্যাঁ দুই ছেলে৷
- বাহ খুব ভাল খবর৷ স্বপ্না বলছিল, তার বাচ্চা হবে
  সে গর্ভধারণ করেছে৷
- Great news, দারুণ খবর দিলেন তো মাসিমা৷ আমি স্বপ্নাভাবির বাড়িতে বিরিয়ানী খেয়ে এলাম৷ ওরা কেউ তো জানালেন না৷
- স্বপ্নাদের তো আজ বিকেলে এখানে আসার কথা তুমি থাকলে দেখা হয়ে যাবে৷
- আমি তো আছি শ্রাবন্তীদের ফ্ল্যাটে, আসলে দেখা হবে৷ বাচ্চু স্বপ্নাভাবি এলে আমাকে খবর দিও৷
- ঠিক আছে আসলে আপনাকে জানাব৷
- মাসিমা পার্বতীদিরা কেমন আছে?
- ভালই আছে৷ ওর বড় মেয়েটা ডাক্তারি পড়ছে ছেলেটা ইন্জিনিয়ারিংয়ে এ বছর ভর্তি হল৷ পার্বতীর আজকে আসার কথা আছে ৷ আসলে তোমার সঙ্গে সবার দেখা হয়ে যাবে৷
এরমধ্যে সাখোয়াত বাজার থেকে ফিরে আমাকে ডেকে নিয়ে সানবাঁধা পুকুরের ঘাটে এসে বসল৷ আমি সাখোয়াতকে জিজ্ঞেস করলাম, তুই শারমিনকে বিয়ে করলি কেন?
- কেন শ্রাবন্তীকে তোর পছন্দ না৷
- না তা না৷ তবে শারমিনকে বিয়ে করবি বলতিস৷ তার সাথে প্রেমও করতিস৷
- শারমিনের আগে তো শ্রাবন্তীকে প্রেম করতাম৷ তার মধ্যে শারমিন চলে এসেছিল৷ আমি বিয়ে করতাম কিন্তু শারমিনের আব্বা লখনউর একজন I.A.S. অফিসার পাত্রের খোঁজ পেয়ে তার সাথে তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দেন৷ শারমিন আমার কাছে এসে খুব কেঁদেছিল৷ সে বলেছিল, চলো টিপু সুলতান মসজিদে গিয়ে আমরা বিয়ে নিই৷ আমিই রাজি হই নি৷ ওকে বলেছিলাম, মাম্মি ড্যাডিকে কষ্ট দিয়ে বিয়ে করলে সুখী হবে না৷ তাদের অভিশাপ মাথায নিয়ে বেড়াতে হবে৷ শারমিন বলেছিল, না ওসব কিছুই হবে না৷ সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে৷
- আমরা এখন গবেষণা করছি৷ বিয়ে করে সংসারের চাপ নিলে গবেষণার কাজ ব্যাহত হবে৷ আমার কথা শুনে শারমিন নিরস্ত হয়েছিল৷ অথচ বিয়ের পরে শারমিন P.hd করল৷ আসলে ভুলটা আমিই করেছিলাম৷ আর শারমিনের বিয়েতে শ্রাবন্তী এসেছিল সেখানে সে নিজেই আমার কাছে এসে বলল, শারমিনের বিয়ে হয়ে গেল এবার চলো আমরা সিভিল ম্যারেজ করে নেব৷ আমি শ্রাবন্তীর প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলাম৷ শারমিন ও নাজনিন দুজনে আমাদের বিয়েতে সাক্ষী হয়েছিল৷ এখনও ওরা দুজন আমাদের ভাল বন্ধু৷ শারমিন ওর বরকে নিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছিল দেখা করতে৷ নাজনিনের একজন ডাক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে৷ তার নাম কামাল আহমদ সে আবার আমাদের কলেজে প্রি মেডিকেল পড়েছিল৷ শারমিনের বর উত্তর প্রদেশ সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কলকাতা দফতরের প্রধান৷
- বাহ! শুনে খুব ভাল লাগল৷ তোরা কতদিন আগে বিয়ে করেছিস?
- দেড় বছর হতে চলল৷
- বিয়ের আগে ফ্ল্যাট নিয়েছিলি?
- না বিয়ের দিন শামিমভাই বউকে কোথায় নিয়ে তুলব জিজ্ঞেস করেছিলেন তখন স্বপ্নাভাবিই তাঁদের এই ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার কথা বলেন৷ আমি শ্রাবন্তীর সঙ্গে কথা বলে রাজি হয়ে যায়৷ খুব বেঁচে গিয়েছি সেলামি বা এডভান্স লাগেনি৷
- তার মানে সবে শামিমভাই আমাদের সহায়তা করেন৷ আশ্চর্য মানুষ বটে আমাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই অথচ আত্মীয়দের চেয়ে অনেক ভালবাসেন আমাদের৷
- মহৎ যে হয় তার সাধু ব্যবহার...
- যথার্থ৷
- তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন এখানে আসা যাওয়া করে?
- কলেজের লেকচারার জামাই পেয়েছে তা কি কম কথা৷ শ্বশুর শাশুড়ি চৌদ্দগুষ্টি পুজোর সময় আসে৷ তাদের পুজোয় আমরা যেমন নতুন কাপড় পরাই তারাও তেমনই আমাদের দেয়৷ আত্মীয়তা রক্ষায় তারা এখনও আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে আমরা তো আজকাল আত্মীয় স্বজন থেকে দূরে থাকি৷ অথচ ইসলাম বলছে, তোমার কোন আত্মীয় সম্পর্ক ছিন্ন করলে তুমি করবে না৷ সেই অনুশাসন ক'জন মানছে? ইসলামের সব অনুশাসন মেনে চললে বিশ্বে মুসলিমদের এই দুরাবস্থা কখনও হত না৷
- সঠিক কথা৷ বিশ্বে বহু অসভ্য জাতি ইসলামের শিক্ষা নিয়ে সুসভ্য হল আর মুসলিমরা হাতের কাছে অনুশাসন পেয়েও নিজেদের শুধরাতে পারল না৷ দিনকে দিন নৈতিক অবক্ষয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে৷
- আরও হবে আরও মার খাবে যদি না ইসলামের নির্দিষ্ট পথ ছেড়ে বিপথগামী হয়৷ সৎ হতে হবে৷ বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে নিজেদের বিশ্বসেরা করতে হবে৷
আমরা কথা বলছিলাম এর মধ্যে বাচ্চু একটি ট্রেতে চা চানাচুর নিয়ে এলো৷ সে বলল, সাখুদা জানেন, সেজ জামাইদা এই পুকুরে হুইল ছিপে একটা বিরাট মাছ ধরেছিল৷
সাখু জানতে চাইল সেজ জামাইদা কে?
- কেন তোমাদের শামিমদা গো৷
- তাই বুঝি? সাখু বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, কতদিন আগের কথা?
- সে অনেকদিন আগে জামাইবাবু তখন ভার্সিটির ছাত্র৷
দেলোয়ার বলল, শামিমভাই তাহলে ভাল শিকারি!
- ভাল শিকারি মানে! বাবা তখন বলেছিল এই ছেলে একটা ডায়মন্ড৷ বহু গুণ সম্পন্ন যুবক৷ ধীর স্থির প্রখর উপস্থিত বুদ্ধি৷ এ রকম ছেলে লাখে একটা মেলে৷ বাবা শামিমদাকে খুব লাইক করত৷ আমি নিজে শুনেছি, একদিন বাবা মা'কে বলছিল এমন ছেলে পাওয়া গেলে স্বপ্নার সাথে বিয়ে দিতাম৷ মা বলেছিল, মুসলিম ছেলের সঙ্গে তোমার মেয়ের বে দেবে৷ বাবা জবাবে বলেছিল, ওর মতো একটা হিন্দু ছেলে খুঁজে আনতে পারবে৷ তাই তো যেদিন শামিমদা দেলোয়ারদাকে সঙ্গে নিয়ে সেজদিকে নিতে এলো সেদিন মা বাধা দেয় নি বরং মেয়েকে নির্দ্বিধায় তাঁর হাতে সঁপে দিয়েছিল৷ সেজদিকে মা তাঁর সব স্বর্ণালঙ্কারে সাজিয়ে দিয়েছিল৷ সেজদি তখন বলেছিল, আমাকে সব দিচ্ছ তো বাচ্চুকে কি দেবে? মা বলেছিল কিনে দেব৷ তুই কি ভাবছিস ওকে কি আর কম দেব? সেজদি বাবার খুব প্রিয়পাত্রী ছিল৷ সেজদি আমাদের বোনদের মধ্যে সেরা৷ তাইতো বাবা সেজদিকে শ্যামবাজারের দুটো দোকান লিখে দিয়েছে৷ অথচ সেজদি বলে দোকানের আয় থেকে আমাকে লভ্যাংশ দেবে ৷ বড়দি ও মেজদি দুজনে নেবে না বলেছে৷ ঝর্ণাদিকে সেজদি দিতে চাই কিন্তু বাবার অবাধ্য হয়ে বিয়ে করায় মা সেজদিকে নিষেধ করে৷ তাই সেজদির ঝর্ণাকে লভ্যাংশ দেবার ইচ্ছে থাকলেও দিতে পারে না৷ আমার সেজদি সব চেয়ে ভাল৷ জানেন, সেজদিকে বাবা ছেলে বলতেন৷ শামিমদাকে যে সিভিল ম্যারেজ করেছিল তা কাউকে জানায় নি৷ কতখানি ধৈর্য সহ্যগুণ থাকলে ওই ধরণের কষ্ট বিয়ার করা যায় ভাবতে পারেন৷
বাচ্চু অনর্গল তার সেজদির ভূয়সী প্রশংসা করে শূন্য চায়ের কাপ সমেত ট্রে নিয়ে চলে গেল৷ আমরা দুই বন্ধুতে বসে বসে গল্প করছিলাম ঝুল বারান্দা থেকে শ্রাবন্তী আমাদের ডেকে নিল৷
- সাখু বলল, চল ও একা একা বোর হচ্ছে৷
                 

 

চলবে…….

 

Post a Comment

Previous Post Next Post