পর্ব-৯
বিচিত্রময় ছেলেবেলা
সেই
সময় আমাদের পাড়াগাঁয়ের ছেলেমেয়েরা খুব কমই পড়াশুনা করত। কেবল মাত্র যাদের আর্থিক অবস্থা
একটু সচ্ছল ছিল কেবল তাদের ছেলে মেয়েরা স্কুল যেত। বাদবাকি ছেলে মেয়েরা ছাগল গরু চরিয়ে
সন্ধ্যার পর টিপ্পি বা কড়ি খেলে দিনপাত করত। অনেকের দুবেলা ভাত জুটানোই মুশকিল ছিল
তার উপরে আবার পড়াশুনা। যাদের সন্তান লালন পালন করতে মুশকিল হতো তারা কেবল এক মুঠো
ভাতের জন্য তাদের ছেলেদের বড়লোকের বাড়িতে ব্যাগার খাটাত। তাদের কাজ ছিল ছাগল গরু চরানো
আর তাদের জন্য খড় আর ঘাস কাটা। এই ভাবেই তারা বছরের পর বছর ধরে পরের বাড়িতে পেটভাত্তা
খাটত।
সেই
সময় সমাজচিত্রের খুব একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেত না। সেই সময় সাইকেলের প্রচলনও তেমন
একটা ছিল না। ফলে দূরের গ্রামে কুটুম বা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গেলে পায়ে হেঁটেই যেতে
হত। কেবল মাত্র মেয়ে আর ছোট বাচ্চারা দূরের গ্রামে কুটুম্ব বাড়ি গেলে তাদের জন্য গরুর
গাড়িতে টাপুর বেঁধে সে টাপুরের সামনে এবং পিছুনে কাপড় বেঁধে টাপুরের ভিতরে নিয়ে যাওয়া
হত। দশ ক্রোশ যেতে প্রায় সারা দিন চলে যেত।ক
ওই
সময় টাপুরের গাড়িতে বরযাত্রী নিয়ে অনেকে বিয়ে করতেও যেতো। নতুন বউ নিয়ে এসে গাড়ি থেকে
নামানোর সময় দুধ দিয়ে বউয়ের পা ধুইয়ে দিতেও দেখে ছিলাম।
সে
সময় সচ্ছল অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিদের গোয়াল ভর্তি গরু থাকত। সেই গোয়ালে যেন কেউ খিল
দিতে না পারে আর গরুর যেন কোন ক্ষতি না হয় সেই কারণে কোন এক হিন্দু গ্রাম থেকে হিন্দু
পুরোহিত এসে ঘণ্টা বাজিয়ে গোয়ালে তিনটি করে সিঁদুরের দাগ দিয়ে যেত। আমরা ছোট ছেলে মেয়েরা
গোল করে ঘিরে সে সব কাণ্ড দেখতাম। সিঁদুর দেওয়া হলে মায়েরা ওই পুরোহিতকে চাল দিয়ে বিদায়
জানাত।
আমিও
কয়েকদিন সেই টাপুরের গাড়িতে চড়ে দূরের গ্রামে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। টাপার ভিতরে
বসে থাকতাম। গাড়ি মাটির রাস্তা দিয়ে হেলতে দুলতে যেত। গাড়ির সামনে গাড়োয়ান বসে গরুকে
হাঁকিয়ে নিয়ে যেত। গাড়ির চাকা থেকে বেরিয়ে আসা ক্যাঁচকুচ শব্দ সারা রাস্তা ধরে চলত।
সেই শব্দেরও যেন তাল-লয়-ছন্দ সবই ছিল। সমতল রাস্তায় চলার সময় এক রকম শব্দ হতো। উঁচুনিচু
রাস্তায় উঠা নামার সময় অন্য রকম শব্দ হতো। ওই শব্দে আমরা কেউ বিরক্ত হতাম আবার কেউ
কেউ বেশ মজা উপভোগ করতাম।
আলবেলা
কথার মাঝেই বলল, ওই গরুর গাড়িতে চড়তে আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে।
আমি
বললাম, সেই গাড়ি এখন কোথায় পাবে? সময়ের স্রোতে সব কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। তারপরের ঘটনা
শুনো। একদিন আমি এরকমই এক গরুর গাড়ির টাপুরের ভিতরে হেলতে দুলতে যেতে যেতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
পাশে ছিল এক হাঁড়ি সন্দেশ। কাগজ দিয়ে মোড়া। ঘুমের অবস্থাতে আমার হাত গেল ওই সন্দেশের
হাঁড়িতে ঢুকে। তারপর সেই কি বিচ্ছিরি ব্যাপার। কুটুম্ব বাড়িতে আলোচনা চলতে লাগল যে
লোভ সামলাতে না পেড়ে আমরা মিষ্টি খেয়ে ফেলেছি।
যারা
পড়াশুনা করত না তারা খেলা ধুলার অগাধ সময় পেত। কখনো কখনো ছেলে মেয়েরা এক সঙ্গে লুকোচুন্নি
খেলত। বিশেষ পদ্ধতিতে একজনকে চোর বানানো হতো আর অন্যরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে
পড়ত। এই লুকানোর জায়গাগুলির মধ্যে ছিল গমের ভুষির ঘর। চারিদিকে কঞ্চি আর পাটকাঠি দিয়ে
বিশেষ ঘর বানানো হত। উপরে থাকতো পাটকাঠির চালা। সেই চোর বিভিন্ন জায়গা থেকে একজন একজন
করে বের করে নিয়ে আসত।
সেই
ছোট বেলায় বাঁশ তলায় চুকুপাতি নিয়ে আমিও মেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করেছি।
আলবেলা
আমার কথায় হাসল। বলল, তুমিও চুকুপাতি নিয়ে খেলেছ!
আমি
বললাম, হ্যাঁ। ছোটছোট ছেলেমেয়েরা ধুলো দিয়ে ঘর বাড়ি তৈরি করত। তারপর বিভিন্ন লতাপাতা
দিয়ে সেই ঘরগুলিকে সাজানো হত। পিঁপড়ের মাটিকে করা হতো চাল। অন্যান্য ছোট ছোট ফলমূলকে
করা হতো তরিতরকারি। খাওয়া দাওয়াও চলত রূপকভাবে।
তখনি
দেখেছিলাম মেয়েদের সংসারের প্রতি কত টান! ওই ছোট্ট বেলায় সংসার গুছানোর কাজও তারা রীতিমতো
শিখে নিয়েছিল।
একদম
সংসার চালানোর আদলেই চলত সেই সব খেলাধুলা। মাঝে মধ্যে এটি নেই, সেটি নেই বলে ক্রাইসিসও
তৈরি করত তারা। রীতিমতো কেউ কেউ দোকান করেও বসত। গাছের পাতাকে টাকা বানানো হত। সেই
টাকা দিয়েই মালপত্র কেনাবেচা হত।
আলবেলা
বলল, তোমার ছোট বেলার গল্প শুনতে আমাকে খুব ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে আমি সেই
ছোট বেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। কত মনোরম ছিল সেই দিনগুলি! তাই না?
আমি
হেসে বললাম, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। মনে হয় একছুটে চলে যাই সেই ছোট বেলায়।
ও
বলল, তারপর?
আমি
বললাম, আমি যখন ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলাম তখন তেমন স্কুল কামাই করতাম না। পড়া দেওয়ারও
তেমন কোন ভয় ছিল না। রাতে আব্বার কাছে পড়া করে নিতাম। স্কুলে ভর্তির আগেই আমার অক্ষর
জ্ঞান হয়ে গেছিল। ফলে বানান করে পড়তে কোন অসুবিধা হতো না।
শীত
আর গ্রীষ্মকালে আমরা কাঠাল গাছের তলায় গোল করে বসতাম আর বর্ষা সময় স্কুলের বারান্দায়
বসে পড়াশুনা করতে হতো। কাঁঠাল গাছটি ছিল স্কুল চত্বরের পূর্ব দক্ষিণ দিকে। যেমন মোটা
তেমনি ঝাঁকড়া মাথার গাছটি। ওর বয়স কত, কে জানে। ওই গাছটিতে সারা বছর কাঁঠাল ধরত। সেই
গাছটির চারিদিকে গোল হয়ে আমরা বসতাম। ঘরে বসার কোন সুযোগ ছিল না। কারণ পুরো স্কুলে
মাত্র দুটি ঘর। সেই ঘরই অফিস আর সেই ঘরই হল ক্লাসরুম।
মা
আমাকে একটি ছোট পাটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই পাটি বগলে নিয়ে মাঠের আল ধরে স্কুল পৌঁছে
যেতাম। তারপর কাঁঠাল গাছের তলায় ফাঁকা জায়গা দেখে পাটি পেড়ে বসে যেতাম। আমার বসার পরও
পাটি ফাঁকা থাকত। কখনো কখনো কাউকে ডেকে নিতাম আবার কেউ কেউ নিজে এসেই বসত। তখন পড়াশুনার
জন্য রীতিমত একটি শাসন থাকত।
যখন
টিফিন হতো তখন ক্লাস ফোরের মেয়েরা এসে পড়া নিত। মাস্টাররা ওদেরকে পাঠাতেন। চারটি ক্লাসের
জন্য মাত্র দুটি মাষ্টার। স্বাভাবিকভাবেই উনারা ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। ক্লাস ফোরের মেয়েরাও
ভাল করে পড়াতে পারত।
ওরা
যখন আমাদের পড়া নিতে আসত তখন আমরা গোল করে লাইন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম ওরা এসে এক একজন
দশ পনের জনের পড়া নিত আবার আগামী কালের জন্য পড়া বলে দিত। বাংলা পড়া দেওয়া শেষ হলে
আমরা গোল করে লাইনে দাঁড়াতাম। তারপর চলত ধারাপাত মুখস্ত করার পালা। ফোরের একজন মেয়ে
আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে যা বলত আমরাও জোরে জোরে চিৎকার করে বলতাম। যাকে বলে একদম
জয়ফুল লার্নিং। একটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে আর একটি নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত প্রায় দশবার
বার করে আবৃত্তি করতে হতো। আবৃত্তি করতে করতে এক সময় আমাদের সংখ্যা, নামতা মুখস্ত হয়ে
যেত।
আমাদের
স্কুলটি ছিল দুটি গ্রামের মাঝামাঝি একটি জায়গায়। স্কুলের তিন পাশে কোন পাড়া বা বসতি
ছিল না। উত্তর দিকে কেবল মাত্র গুটি কয়েক বাড়ি ছিল। স্কুলের পূর্ব দিকে বিস্তৃত সবুজ
মাঠ। দক্ষিণে হাইস্কুল। হাইস্কুলের ওপারে একটি বড় পুকুর। পুকুরের পূর্ব পাড়ে পঞ্চায়েত
অফিস আর একটি খুব প্রাচীন বড় বটগাছ। তাদের পূর্ব পাড়ে হসপিটাল। পশ্চিমে একটি বড় পাড়
বাঁধা পুকুর। তার ওপারে একটি বড় আম বাগান। আম বাগানে কেবল আম গাছ ছিল তাই নয়। সেখানে
ছিল বড় বড় তেঁতুল গাছ। একটি কৎবেল গাছ। কয়েকটি কাঁঠাল গাছ। টিফিনের সময় ওই পুকুর পাড়
দিয়ে আমরা ছেলে মেয়েরা এক সঙ্গে তেঁতুল পাড়তে যেতাম। মেয়েরা তেঁতুল পাড়ার জন্য আমাদেরকে
খুব অনুরোধ করত। আমরা গাছে উঠে তেঁতুল পেড়ে তাদেরকে দিতাম। সেই তেঁতুল পেয়ে মেয়েদের
কতই না আনন্দ! যদি তেঁতুল পেড়ে ওদেরকে না দিতাম তাহলে কয়েকজন মিলে আমাকে ঘিরে ধরত।
কখনো কখনো জড়িয়ে ধরে কেড়ে নিত।
আলবেলা
ঠাট্টার সুরে বলল, তারমানে ছোটবেলা থেকেই প্রেম; তাই না?
আমি
বললাম, তখন প্রেমটেম বুঝতাম না। তবে সেই দিনগুলি সোনার মতো চিকচিক করে। সেই সময় আমাদের
স্কুলে সৌচালয়ের কোন ব্যাবস্থা ছিল না। ফলে প্রসব বা পায়খানা পেলে মাঠে বা বাগানে যেতে
হতো। কখনো কখনো মাঠে বা বাগানে যেতে গিয়ে প্যান্টেই পায়খানা করে বসত। এমনও দেখা গেছে
ক্লাস চলাকালীন শিক্ষক মহাশয় কোন ছাত্রকে বাইরে যেতে না দিলে বসে বসেই প্যান্ট নষ্ট
করে দিয়েছে।
সেই
প্রাইমারীতে পড়ার সময় দেখলাম আমাদের স্কুলে একটি বড় যাদু খেলার দল এসেছে। স্কুলের সমস্ত
চত্বরকেই তারা টিন দিয়ে ঘিরে রেখেছিল। রাস্তার দিকে বড় বড় হোর্ডিং টাঙ্গানো। সেই হোর্ডিং-এ
বিভিন্ন রকম খেলার চিত্র অঙ্কন করা ছিল। তার মধ্যে একটি রাক্ষসেরও ভয়ঙ্কর চিত্র অঙ্কন
করা ছিল।
সপ্তাহে
একদিন করে আমাদেরকে ফ্রিতে সেই যাদু খেলা দেখানো হতো। অবশ্য ভয়ঙ্কর খেলাগুলি আমাদেরকে
দেখানো হতো না। যেমন রাক্ষসের খেলা আমাদেরকে দেখানো হয়নি।
সে
সব খেলার মধ্যে যেটি আমার মনের মধ্যে এখনো দাগ কেটে রয়েছে সেই খেলাটি হল একটি মানুষের
জায়গায় অন্য মানুষের আবির্ভাব। সেদিন দেখেছিলাম, সেই খেলার যিনি সর্দার সেই সর্দারকে
একটি কালো কাপড়ের বড় বস্তায় ঢুকিয়ে দিল। সেই বস্তার মুখ শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হল। তারপর
তাকে একটি বাক্সের মধ্যে ভরে উপর থেকে ঢাকনা নামিয়ে তালা মেরে দেওয়া হল। বাক্সের পাগুলি
এত ছোট ছিল না যে তার তলা দিয়ে এপার ওপার দেখা যেতো না। তাছাড়া বাক্সে রাখার আগে আমরা
বাক্সটিকে ভাল করেই দেখে ছিলাম। কোন জায়গায় কোন রকম ফুটো ছিল না।
কিছুক্ষণ
পর দেখলাম ওই সর্দার গ্রিন রুম থেকে বেরিয়ে আমাদের সামনে আবির্ভাব হলেন। আমি অবাক হয়ে
গেলাম। কে এই ব্যক্তি? যাকে বাক্সে ভরা হয়েছে আর যিনি দাঁড়িয়ে আছেন? দুজনেই কি একই
ব্যক্তি? না আলাদা? যারা সর্দারকে কাপড়ের বস্তায় ভরেছিলেন তাদেরকে এই সর্দার বললেন-
এই বাক্সে কি আছে?
ওরা
অবাক হয়ে বলল, মহারাজ, আপনাকেই তো এই বাক্সে ভরে রেখেছি।
আমাকে!
তাহলে আমি এখানে কিভাবে দাঁড়িয়ে? বাক্স খুলো তো, কে আছে দেখি।
বাক্স
খুলা হল। সেই মুখ বাঁধা কালো কাপড়ের বস্তা বের করা হল। বস্তার মুখ খোলা হল। কিন্তু
সেই বস্তা থেকে বেরিয়ে এলো ফুটফুটে সুন্দরী একটি যুবতী। আমার মুখটি কেবল হাঁ হয়ে রইল।
আমি
যখন ক্লাস টু-এ ভর্তি হলাম; তখন সকলেই আমাকে ভয় দেখাতে শুরু করল টু-এ কোন রকম বানান
করে পড়া চলবে না। ফলে শুরু হল রিডিং পড়ার পালা। কিভাবে রিডিং পড়া যায় তার চর্চা। তখনও
আমি বই পাইনি। মামাদের পুরাতন বই নিয়ে পড়া। কিছু দিনের অভ্যাসেই রিডিং পড়া শিখে নিলাম।
যেদিন
প্রথম ক্লাস শুরু হল সেই দিন মাষ্টার মহাশয়কে বললাম, স্যার আমি তো বই পাই নি।
উনি
আমার দিকে তাকালেন।
আমি
বললাম- স্যার, যেটি আপনি পড়া নিবেন সেটি আমার মুখস্ত হয়ে আছে।
উনি
বললেন- বল।
আমি
শুরু করলাম, “বাদল করেছে। মেঘের রঙ ঘন নীল। ঢং ঢং করে ন’টা বাজল। বংশু ছাতা মাথায় কোথায়
যাবে? ও যাবে সংসার বাবুর বাসায়। সেখানে কংস বধের অভিনয় হবে। আজ মহারাজ হংসরাজ সিংহ
আসবেন।”
এই
পর্যন্ত পড়তেই উনি বললেন, থামো।
আমি
যখন পড়ছিলাম তখন উনি আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে ছিলেন। উনি বললেন, বস।
আমি
এক বুক আনন্দ নিয়ে বসলাম। তারপর আমাকে আর রিডিং পড়ার জন্য পিছুনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
আমি হয়ে উঠলাম সেই শিক্ষকের প্রিয় ছাত্র, যিনি আমাকে আমার স্কুল জীবনের প্রথম দিনই
নির্মমভাবে মেরেছিলেন।
সেই
সময় আমাদের স্কুলের সামনে আর হাইস্কুলের পিছুনে দেয়াল লাগা একটি আতা গাছ ছিল। যাদের
পড়া হত না সেই গাছের ডাল ভেঙ্গে এনে শিক্ষক মহাশয়কে ছাত্ররাই দিত। সেই ডাল দিয়ে কি
মার! যারা মার খেত তাদের পিঠে কালো কালো দাগ হয়ে যেতো। সে কি কান্না! তবুও তিনি থামতেন
না।
একদিন
কারো পড়া হল না। ছড়ি নিয়ে এসে প্রত্যেককে দু-ছড়ি করে মারা হল। সেই মার দেখেই একজন চিৎকার
করে কান্না জুড়ে দিল। তবুও তাকে কোন রকম ছাড় দেওয়া হল না।
তারপর
যখন আমরা ক্লাস টু থেকে ক্লাস থ্রিতে উঠলাম তখন আমাদের একটি সাবজেক্ট যোগ হল। সেটি
হল গানের ক্লাস। শিক্ষক মহাশয় আমাদেরকে সুন্দর করে গান শিখাতেন। শিক্ষক মহাশয়ের সঙ্গে
আমরাও সকলে এক সঙ্গে সুর করে গান গাইতাম। গানগুলির মধ্যে অধিকাংশ ছিল রবীন্দ্র সঙ্গীত।
আমরা
ছেলে মেয়েরা এক সঙ্গেই ক্লাস করতাম। ফলে খেলাধুলা গান বাজনা এক সঙ্গেই চলত।
একদিন
গল্প করতে করতে ওই শিক্ষক মহাশয় আমাকে বলেছিলেন, “তুমি একজন মাষ্টার হবে।” কথাটি আমার
এখনও মনে আছে। তবে আমি ক্লাসের মধ্যে বয়সে সব চেয়ে ছোট ছিলাম। এমন ছোট ছিলাম যে আমার
কোন কোন ক্লাসমেটদেরকে আপনি বলেও সম্বন্ধন করতাম।
যখন ফোরে উঠলাম তখন দেখলাম কয়েক দিন
থেকে একটি মেয়ে স্কুল আসছে না। রিতাকে বললাম, “কি ব্যাপাররে, তুহিনা স্কুল আসছে না
কেন?”
রিতা হেসে বলল, “তুহিনার বিয়ে হয়েছে,
তুই জানিস না?”
তুহিনা অবশ্য আমার চায়তে চার-পাঁচ
বছরের বড় হবে। তবুও ওর বিয়ের বয়স হয়েছিল বলে মনে হয়নি। আমরা যখন ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম
তখন ছেলে মেয়ে নিয়ে প্রায় পঞ্চাশ জন ছাত্র ছিলাম। কিন্তু ফোরে এসে দেখলাম আমরা মাত্র
আঠার জন আছি। কে, কোথায়, কিভাবে চলে গেছে চুপিচুপি সেটি বুঝতেই পারিনি।
হয়তো এভাবেই কত ফুল ফুটে, কত ফুল ঝরে
যায় অকালে চুপিচুপি। আমরা কোনটিরই বা খবর রাখি?
আলবেলা হাঁই তুলে বলল, আজ ঘুমাও। আবার
কাল শুনবো।